সারভাইকাল ক্যান্সার (Cervical Cancer) বা জরায়ু মুখের ক্যান্সার মহিলাদের জন্য একটি ভয়াবহ ব্যাধি। ভারতে জরায়ু মুখ ক্যান্সার, ক্যান্সারে আক্রান্ত মহিলাদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা বিশ্বে মহিলাদের ক্যান্সারের মধ্যে এটি তৃতীয় স্থানে রয়েছে।
এই ক্যান্সারে, জরায়ুমুখে, গর্ভাশয়ে বা জরায়ুর নিচের অংশে কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে নিরাময় সম্ভব, নয়তো ক্যান্সার শরীরের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সঠিক সময় সারভাইকাল ক্যান্সারের রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যান্য ক্যান্সারের মতো, সারভাইকাল ক্যান্সারেরও নির্দিষ্ট কিছু কারণ রয়েছে, সেগুলো কী কী? কী কারণে বাড়তে পারে ক্যান্সারের ঝুঁকি? ক্যান্সার প্রতিরোধ বা চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কী? জরায়ু মুখের ক্যান্সার সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর পেতে, শুনুন কী বলছেন মেডিকেল অনকোলজিস্ট ডাঃ রাজীভ জেনা।
Table of Contents
সারভাইকাল ক্যান্সার কী?
সারভাইকাল ক্যান্সার বা জরায়ু মুখের ক্যান্সার কী জানতে হলে আমাদের প্রথম ফিমেল জেনিটাল ট্র্যাকটার অ্যানাটমিটা জানতে হবে। প্রথম উপরে আছে ইউট্রাস, যেটা হল এটি ফাঁপা পেশীময় অঙ্গ (Hollow Organ)। ইউট্রাস বা জরায়ুতে প্রেগনেন্সির সময় বাচ্চা ন’মাস ওখানেই থাকে। ওটার নিচের দিকে ইউট্রেন ওপেনিংটাকেই সার্ভিক্স বলি বা জরায়ুর মুখ বলি। এই মুখটা ওপেন হচ্ছে নিচের দিকে ভ্যাজাইনাল ক্যানালে যেটাকে আমরা বার্থ ক্যানাল বলি বা জন্মনালী বলি। যখন সার্ভিক্সের বা জরায়ুর মুখের ক্যান্সার হয় ওটাকে আমরা সারভাইকাল ক্যান্সার বলে থাকি।
সারভাইকাল ক্যান্সারের কারণ কী?
সারভাইকাল ক্যান্সারের প্রধান কারণ হিসেবে আমরা জানি যে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস বা HPV ভাইরাস, একধরণের ভাইরাস, যেটা যৌনবাহিত রোগ। এটা খুব সাধারণ কারণ। 95-99% এর ক্ষেত্রে HPV ভাইরাস হল প্রধান কারণ যা সারভাইকাল ক্যান্সারের জন্য দায়ী। HPV ভাইরাসের অনেক ভ্যারিয়েন্ট আছে। ওদের মধ্যে HPV 16 & 18, 70-80% এর ক্ষেত্রে সারভাইকাল ক্যান্সারের কারণ।
সারভাইকাল ক্যান্সারের ঝুঁকির কারণ কী?
মহিলাদের অল্প বয়সে বিয়ে বা অল্প বয়সে যৌন মিলন এটা একটা রিক্স ফ্যাক্টর। একইভাবে একজন মহিলার যদি একাধিক যৌনসঙ্গী থাকে বা যদি তার পার্টনার আছে যা একাধিক মহিলাসঙ্গী আছে, অথবা যদি একজন মহিলা একাধিক সন্তান আছে, তাছাড়া যদি পাঁচ বছরের বেশি জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি খেয়ে থাকে ওটাও একটা রিক্স ফ্যাক্টর। এছাড়াও ধূমপান একটি রিক্স ফ্যাক্টর। আর দেখা গেছে যাদের ইমিউনিটি পাওয়ার অর্থাৎ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, যেমন যদি কারও এইচআইভি ইনফেকশন হয়ে থাকে ওদের সারভাইকাল ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
সারভাইকাল ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কী কী?
সারভাইকাল ক্যান্সারকে আমরা এই ভাগে ভাগ করতে পারি, প্রিক্যান্সারাস, আর্লি স্টেজ এবং লেট স্টেজ। প্রিক্যান্সারাস অর্থাৎ এখনও অবধি ক্যান্সার হয়নি কিন্তু এমন একটা স্টেজে আছে যে ক্যান্সার হয়ে যাওয়ার চান্স অনেক বেশি। প্রিক্যান্সারাস, আর্লি স্টেজে অনেক সময় কোনও লক্ষণ বা উপসর্গ নাও থাকতে পারে। প্রধাণত যে লক্ষণ গুলি দেখা দেয় সেগুলি হল – অস্বাভাবিক রক্তপাত, যদি দুটো মেনস্ট্রুয়াল সাইকেলের মাঝেও ব্লিডিং হচ্ছে কিংবা মেনস্ট্রুয়াল সাইকেলের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে অথবা যদি মেনস্ট্রুয়াল সাইকেলের সময় বেড়ে যায়। তাছাড়া যদি যৌন মিলনের পর ব্লিডিং হয়, মেনোপজের পর রক্তপাত, তীব্রগন্ধযুক্ত যোনি স্রাব এর লক্ষণ ও উপসর্গের মধ্যে পড়ে। আরও কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যেমন ওজন কমে যাওয়া, খিদের ইচ্ছে চলে যায়, ক্লান্তি, দুর্বলতা, এছাড়া যদি রোগটা অনেক ছড়িয়ে পড়ে তখন ব্যথা হতে পারে। রোগটা যদি নিকটবর্তী অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে যদি ব্লাডারে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে ব্লাডার সম্পর্কিত সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন বার বার প্রস্রাব, প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা। একইভাবে পিছনে রেকটাম আছে সেখানে যদি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে রেকটামে ব্লিডিং হতে পারে বা কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়ার মতো সমস্যাও হতে পারে।
সারভাইকাল ক্যান্সারের স্টেজগুলো কী কী?
সারভাইকাল ক্যান্সারের রোগটা কোথায় আছে এবং কতদূর ছড়িয়ে পড়েছে তার উপর নির্ভর করে আমরা স্টেজিং করি। রকমের স্টেজিং হয় তবে সাধারণ যেটা ফলো হয় সেটা ফিগো স্টেজিং। ওই স্টেজিং হিসেবে স্টেজ 1,2,3,4 ভাগ করা হয়েছে। স্টেজ 1 হচ্ছে যদি শুধু সার্ভিক্সে রোগটা থাকে, স্টেজ 2 আর স্টেজ 3 হল যদি সার্ভিক্স থেকে বাইরে চলে গেছে কিন্তু পেলভিক রিজিওনের বাইরে চলে যায়নি। স্টেজ 4 কে ভাগ করা হয়েছে স্টেজ 4A আর স্টেজ 4B। স্টেজ 4A হচ্ছে রোগটা কাছাকাছি অঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে আর স্টেজ 4B হচ্ছে যখন রোগটা অনেক দূরে ছড়িয়ে গেছে।
সারভাইকাল ক্যান্সারের রোগ নির্ণয় কীভাবে করা হয়?
সারভাইকাল ক্যান্সার প্রিক্যান্সারাস স্টেজেও থাকতে পারে অর্থাৎ এখনও ক্যান্সার হয়নি কিন্তু হয়ে যাওয়ার চান্স বেশি। ওইরকম ক্ষেত্রে আমরা ভিজুয়ালি একটা আলসার দেখতে পারি না, তখন কল্পস্কোপ দিয়ে কিছু কেমিক্যালস যেমন অ্যাসিটিক অ্যাসিড, লুগলস আয়োডিন দিলে কিছু রঙ পরিবর্তন হয় ওই জায়গা থেকে আমরা বায়োপসি নিয়ে ডায়াগনোসিস করতে পারি। আবার যদি ভিজুয়াল টিউমার বা আলসার আছে ওখান থেকে আমরা পাঞ্চ বায়োপসি নি, এই বায়োপসি থেকে আমরা কনফার্ম করি যে সারভাইকাল ক্যান্সার আছে।
সারভাইকাল ক্যান্সারের চিকিৎসার বিকল্পগুলি কী কী?
সারভাইকাল ক্যান্সার কোন স্টেজে প্রেজেন্ট করছে ওর উপর নির্ভর করছে ট্রিটমেন্ট। যদি প্রিক্যান্সারাস অর্থাৎ ক্যান্সার এখনও হয়নি তখন আমরা thermal ablation, cryotherapy, Loop Electrosurgical Excision Procedure (LEEP) এগুলো দিয়ে ট্রিটমেন্ট করে থাকি। আর্লি স্টেজে সারভাইকাল ক্যান্সারের দুটো অপশন আছে, সার্জারি করা যায় অথবা রেডিওথেরাপি করা যায়। রোগটা যদি স্থানীয়ভাবে অ্যাডভান্স হয় তাহলে রেডিওথেরাপির সাথে আমাদের কেমোও দিতে হয়। এছাড়া আমরা ব্রাকিথেরাপিও করে থাকি। এছাড়া যদি পুরো অ্যাডভান্স, স্টেজ 4B, রোগটা অন্য জায়গায় ছড়িয়ে গেছে যেখানে সার্জারি, রেডিওথেরাপি সম্ভব নয়, ওখানে আমাদের কেমোথেরাপি দিতে হয়, এখন টার্গেটেড থেরাপি এবং ইমিউনোথেরাপিরও অপশন আছে।
সারভাইকাল ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায় কী?
সারভাইকাল ক্যান্সার প্রতিরোধ আমরা দুটি উপায়ে করতে পারি। প্রথম হচ্ছে HPV ভ্যাকসিনেশন। ভ্যাকসিনেশনটা একধরণের প্রাইমারি প্রিভেনশন। ভ্যাকসিনটা 9-26 বছর বয়স পর্যন্ত দেওয়া যেতে পারে। অনেকগুলো অপশন রয়েছে, সার্ভারিক্স, গার্ডাসিল, এই ভ্যাকসিনগুলো আমাদের এখানে পাওয়া যায়। তাছাড়া গার্ডাসিল 9 পাওয়া যায়।
প্রতিরোধের দ্বিতীয় উপায় হল স্ক্রিনিং। রোগ হয়েছে কিনা জানতে একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর স্ক্রিনিং করে দেখতে থাকি। এর ফলে রোগ বেড়ে যাওয়ার আগেই ধরে ফলতে পারব এবং প্রাথমিক চিকিৎসা করতে পারব। এটি খুবই কার্যকরি পদ্ধতি। কারণ দেখা গেছে, সারভাইকাল ক্যান্সারের ক্ষেত্রে প্রিক্যান্সারাস থেকে ক্যান্সার হতে মোটামুটি 10-20 বছর লাগে। যদি আমরা রেগুলার ফলো করতে থাকি তাহলে ক্যান্সারটা আমরা প্রিক্যান্সারাস বা আর্লি স্টেজে নির্ণয় করতে পারব। ভালো ট্রিটমেন্ট দিতে পারব এবং রোগীর আয়ু অনেকটায় বাড়াতে পারব।
HPV পরীক্ষা এবং PAP পরীক্ষা কি? এগুলো কিভাবে কাজ করে? কতটা সময় অন্তর এই পরীক্ষাগুলি করানো উচিত? সব মহিলা এই পরীক্ষা করাতে পারে?
স্ক্রিনিং অনেকগুলো পদ্ধতিতে করা যায়। এর মধ্যে হল PAP বা প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট। সারভাইকাল রিজিওন থেকে স্মিয়ার নিয়ে মাইক্রোস্কোপের নীচে পরীক্ষা করে দেখি, যদি কিছু অ্যাবনর্মাল সেল বা ক্যান্সারাস সেল থাকে তাহলে সেগুলো ধরা পড়ে, তাহলে আমরা ক্যান্সার হয়েছে বুঝতে পারি কিনা। ওই হিসেবে আমরা ট্রিটমেন্ট করি।
একইভাবে আরেকটা হচ্ছে visual inspection with acetic acid। যেখানে প্যাপ স্মিয়ার করা যাচ্ছে না ওখানে আমরা শুধু একটা কেমিক্যাল অ্যাসিটিক অ্যাসিড লোকালি অ্যাপ্লাই করলে একটা কালার চেঞ্জ হয়, সেটা আমরা চোখে দেখতে পারব। ভিজুয়াল ইনস্পেকশন উইথ অ্যাসিটিক অ্যাসিডও এক ধরণের স্ক্রিনিং।
এছাড়া আরেকটা উপায় আছে ওটা হচ্ছে HPV টেস্টিং। আমরা সরাসরি দেখছি HPV আছে কি না। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস যদি থাকে তাহলে ক্যান্সার হওয়ার চান্স বেশি। HPV টেস্টিং DNA টেস্টিং হতে পারে, mRNA টেস্টিং হতে পারে, এখন আরও অনেক নতুন টেস্টিং বেরোচ্ছে।
মহিলা যারা যৌনভাবে সক্রিয় ওদেরই সারভাইকাল ক্যান্সার হতে পারে। তাহলে মোটামুটি প্রত্যেক মহিলার এই চেকআপ করানোটা দরকার। 30-65 বছর পর্যন্ত এই স্ক্রিনিং টেস্ট করলে লাভ আছে। প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট করালে 3 বছর অন্তর করতে হবে। HPV টেস্টিং 5 বছর অন্তর করতে হবে। প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট এবং HPV টেস্ট একসঙ্গে করা যেতে পারে, ওটাও 5 বছর অন্তর করতে হয়। এছাড়া যদি স্ক্রিনিং ছাড়া কারও প্রিক্যান্সারাস কারণ পাওয়া গেছে তাকে 20 বছর পর্যন্ত এরকম স্ক্রিনিং করে যেতে হবে।