প্রত্যেক বছর ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস (World Cancer Day) হিসেবে পালিত হয়। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় চলছে সচেতনতার প্রচার। অনকোর চিফ অনকোলজিস্ট, ডাঃ অমিত জোতওয়ানি, এই নিবন্ধে তুলে ধরেছেন কীভাবে আমরা একজন দায়িত্ববান নাগরিক হিসাবে আমরা ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পারি এবং আমাদের সমাজকে ক্যান্সার মুক্ত থাকতে সাহায্য করতে পারি।
সুস্বাস্থ্য, সমৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা মানুষকে নতুন আশার আলো দেখায় এবং সুখ-আনন্দে ভরে ওঠে। কারণ সুখের দিনগুলোতে আমরা এই সত্যিটা ভুলে যাই যে আমরা কতটা ভঙ্গুর। আমরা আমাদের স্বাস্থ্যকে উপেক্ষা করতে থাকি যতক্ষণ না তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাঘাত ঘটায়। আজ আমরা সবচেয়ে যে বাস্তব বিপদের সম্মুখীন হচ্ছি তা হল আমাদের স্বাস্থ্যের চাহিদা সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং অসাবধানতা। ফলস্বরূপ বহু সংখ্যক মানুষের মধ্যে জীবনহানিকর অবস্থা নির্ণয় করা হচ্ছে। যেমন, কিডনি ফেলিওর, হার্টের অবস্থা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ক্যান্সার। কিন্তু এখনও আমরা দায়িত্ববান সমাজ হিসাবে এই উদ্বেগজনক লক্ষণগুলিকে উপেক্ষা করেই চলেছি।
এমনটা অনুমান করা হয়েছে যে, প্রতি দশজন ভারতীয়ের একজন তাদের জীবনের কোনও না কোনও সময় ক্যান্সারে ভুগবেন। এখন এটি একটি গুরুতর স্বাস্থ্য এবং মানবিক সমস্যা যা জরুরী ভিত্তিতে সমাধান করা প্রয়োজন। ক্যান্সার মোকাবেলা করার 3টি প্রাথমিক উপায় রয়েছে। প্রথমটি হল ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমানো, দ্বিতীয়টি হল তাড়াতাড়ি রোগ নির্ণয় করা এবং তৃতীয়টি হল সঠিকভাবে এবং সময়মতো চিকিৎসা করা।
ক্যান্সারের ক্রমবর্ধমান প্রকোপের জন্য দায়ী তিনটি কারণ হল পরিবর্তনশীল জীবনধারা, খাদ্যাভ্যাস এবং কার্সিনোজেনের ক্রমবর্ধমান এক্সপোজার। আমরা সমাজে যত বেশি আধুনিকত্ব দেখতে পাচ্ছি, তত বেশি মানুষের জীবনযাপন এমন হয়ে উঠছে যেখানে শারীরিক ক্রিয়াকলাপ খুবই কম। এখন বলা হয় যে সারাদিন বসে থাকা ধূমপানের আরেক রূপ কারণ এটি ধূমপানের মতো সমান ক্ষতি করতে পারে। শারীরিক কার্যকলাপের অভাব শরীরের গঠনে বিপজ্জনক পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যায় যা শরীরে ক্যান্সারের বিকাশের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। একটি আসীন জীবনধারার সাথে যুক্ত সাধারণ ক্যান্সার হল স্তন এবং কোলন ক্যান্সার এবং এই ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে নিয়মিত ব্যায়াম করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
আরেকটি কারণ যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় তা হল খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন। আমরা আমাদের কর্মজীবন নিয়ে যত বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ি, আমরা সতেজ এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার গুরুত্বকে উপেক্ষা করতে শুরু করি। আমরা অনেকেই প্যাকেটজাত খাবার খেতে পছন্দ করি যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই বিপজ্জনক। বিভিন্ন ধরণের তাজা খাবার আমাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি এবং খনিজ সরবরাহ করতে সাহায্য করে যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করে এবং রোগ শুরু হওয়ার প্রাথমিক মুহুর্তে প্রতিরোধ করে। সংরক্ষিত খাবার বা প্যাকেটজাত খাবারগুলি প্রাথমিক পর্যায়ে অস্বাভাবিক কোষগুলির সাথে লড়াই করার জন্য ইমিউন সিস্টেমের ক্ষমতাকে দমন করে এবং এটি সেই কোষগুলিকে আরও বাড়তে এবং ক্যান্সার সৃষ্টি করতে উৎসাহিত করে।
ক্যান্সারের তৃতীয় এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল কার্সিনোজেনের মতো ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসা। গবেষণায় দেখা গেছে যে অটোমোবাইল নিষ্কাশন, নির্মাণ কার্যক্রম থেকে ক্রমবর্ধমান দূষণের মাত্রা ক্যান্সারের ঘটনা বাড়াচ্ছে, বিশেষ করে ফুসফুসের এবং পেটের অঙ্গগুলির ক্যান্সার। সব ধরনের তামাকের সক্রিয় ব্যবহার (চিবানো, ধূমপান) সরাসরি মাথা, ঘাড় এবং খাদ্য নালীর ক্যান্সারের কারণ। অ্যালকোহল সেবন সরাসরি লিভার এবং পাকস্থলীর ক্যান্সার সহ বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
উপরন্তু, কিছু ক্যান্সার ভাইরাল সংক্রমণের কারণেও হতে পারে যেমন হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস যা সারভাইকাল এবং যৌনাঙ্গের ক্যান্সার সৃষ্টি করে, হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস লিভার ক্যান্সারের কারণ হতে পারে এবং এইচআইভি ভাইরাস বিভিন্ন ধরণের অন্যান্য ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
আমরা কিভাবে কাজ করতে পারি?
- হেলদি লাইফস্টাইল বেছে নিন: শরীরের সঠিক ওজন বজায় রাখা এবং সক্রিয় জীবনযাপন আপনার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে। আপনার জীবনযাত্রায় সহজ পরিবর্তন ক্যান্সার প্রতিরোধের দিকে একটি সূচনা হতে পারে। প্রক্রিয়াজাত খাবার, রেড মিট, চিনিযুক্ত পানীয় ইত্যাদি পরিহার করা এমন একটি পরিবর্তন হতে পারে। আরও তাজা ফল এবং শাকসবজি গ্রহণ করাও এতে অবদান রাখতে পারে। এটি আপনার ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা 70% পর্যন্ত কমিয়ে দেয়।
- সমাজে সচেতনতা ছড়িয়ে দিন যাতে আমরা পরিবেশ এবং জীবনযাত্রাকে সুন্দর ও সুরক্ষিত রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারি। একটি স্বাস্থ্য-সচেতন সমাজ সবাইকে সুস্থ জীবনযাপনে সহায়তা করে।
- নিয়মিত নিজের চেক-আপ করান: যখন প্রশ্ন ওঠে ক্যান্সার নিয়ে, কেউই কিন্তু এর ভয়াবহতা থেকে ছাড় পায় নেই। প্রত্যেক বছর নিয়ম করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা যে কোনও অস্বাভাবিকতা তুলে ধরতে পারে যার জন্য আরও তদন্তের প্রয়োজন। আপনার স্তনে কোনও লাম্প বা পিণ্ড রয়েছে কিনা যাচাই করার জন্য নিয়মিত পরীক্ষা করুন। ভারতে মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার হল সবচেয়ে সাধারণ ধরনের ক্যান্সার এবং প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে এটি সহজেই নিরাময়যোগ্য। আপনার কোন স্ক্রীনিং টেস্ট করা উচিত তা জানতে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন এবং আপনার ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে জানান। স্তন এবং জরায়ুর ক্যান্সার খুব প্রাথমিক পর্যায়ে সহজ স্ক্রীনিং টেস্টের মাধ্যমে সনাক্ত করা যেতে পারে।
- তামাক ত্যাগ করুন: তামাক ক্যান্সারের সবচেয়ে প্রতিরোধযোগ্য কারণ। স্তন এবং জরায়ুর ক্যান্সারের পরে, ভারতে সবচেয়ে সাধারণ ধরনের ক্যান্সার হল ঠোঁট এবং মৌখিক গহ্বরের ক্যান্সার। তামাক এই ধরনের ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান কারণ। ফুসফুস, মৌখিক এবং জরায়ু সহ বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার ছাড়াও তামাক আরও অনেক অসুস্থতার কারণ। তামাকের অভ্যাস ছাড়তে সমস্যা হলে, একজন আসক্তি মুক্ত করার কাউন্সিলারের সাথে কথা বলুন যিনি আপনাকে সফল হতে সাহায্য করবেন।
সামনে দীর্ঘ পথ
যে কোনও মূল্যে আমাদের স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, এবং পরিবেশ সংরক্ষণ করতে হবে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের দিকে ফিরে যেতে হবে যেখানে আমাদের প্যাকেটজাত খাবারের ব্যবহার কমাতে হবে এবং তাজা ফল ও শাকসবজি বেশি পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ক্যান্সারের যত্নকে সকলের জন্য সহজলভ্য এবং সমতাবাদী করার জন্য অনেক কাজ করা বাকি আছে। স্ক্রীনিং এবং ক্যান্সারের প্রাথমিক সনাক্তকরণের জন্য আরও প্রচেষ্টা প্রয়োজন। প্রত্যেক ক্যান্সার রোগীকে সঠিক এবং সময়মতো যত্ন পাচ্ছে কিনা সেটা আমাদের সুনিশ্চিত করতে হবে। আমরা সকলে মিলে একজোট হয়ে প্রচেষ্টা করলে কার্যকরভাবে সমাজে ক্যান্সারের বোঝা কমাতে পারি।
সম্পর্কিত পোস্ট:
কর্মক্ষেত্রে ক্যান্সার সচেতনতা প্রচারের ১০টি উপায়
বিশ্ব ক্যান্সার দিবস ২০২৩: ‘ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ’ (World Cancer Day 2023)
(https://casadelninobilingual.com/)