পিহুর জন্য বাঁচা: পড়ুন অল্পবয়সী এক মায়ের গল্প – যিনি সন্তানকে বড় করার জন্য ক্যান্সারের সাথে লড়াই করেছেন!

by Team Onco
290 views

আমার নাম স্বেতা সারভেদা প্যাটেল, বয়স ২৭ বছর এবং আমি একজন মা। উপরের ছবিতে ছোট্ট মেয়েটি আমার মেয়ে পিহু। আমার স্বামী মেয়েকে দেখে এখনও আশ্চর্য হয় যে কী করে ও এতটা পুতুলের মতো দেখতে। আজ আমি বিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি – আক্ষরিক অর্থেই আমার মেয়ে অন্ধকার সময়ে আমার জীবন আলোকিত করে তুলেছিল। আমি যখন নয় মাস প্রেগনেন্ট তখন আমার ক্যান্সারের একটা বিরল রোগ ধরা পড়ে। এটি আমাদের লড়াইয়ের গল্প।

সুখের দিনগুলি

আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি, সেখানে পরিবারে নতুন সদস্য আশার থেকে খুশির আর কিছু হতে পারে না। যখন আমি জানতে পারলাম যে আমি গর্ভবতী, তখন খুব আনন্দিত হয়েছিলাম। আমি আমার স্বামী ও তার পরিবারের জন্য সবচেয়ে গুরুপূর্ণ হয়ে উঠেছিলাম।

সময়টা ২০১৫ সালের শেষের দিকে। আমার স্বামী ভাভেশ, যিনি সেই সময়ে একজন স্বনামধন্য ডাক্তার এবং একজন ডেন্টিস্টের সঙ্গে কাজ করছিলেন। আমাকে সাধ্যমতো চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার সমস্ত চেষ্টা করেছিলেন। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল, যতক্ষণ না একজন ডাক্তার প্রথম ট্রাইমেস্টারে আমাদের বলেছিলেন, আমার রুটিন সোনোগ্রাফি রিপোর্টগুলির মধ্যে একটিতে সামান্য অস্বাভাবিকতা ছিল। কিন্তু চিকিৎসকরা জোর দিয়ে বলেছিলেন যে এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই এবং আমাদের সুস্থ প্রসবের দিকে মন দেওয়া উচিত।

তাই আমার ফের স্বপ্ন দেখতে শুরু করি, কত পরিকল্পনা, গান গাওয়া, পরিবারের সঙ্গে হইহুল্লোড়ে মেতে উঠেছিলাম।

গর্ভাবস্থায় মহিলাদের মধ্যে বিভিন্ন অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দেয় যেমন – ঘন ঘন বমি, বমি ভাব, লালসা, পেটে ব্যথা এবং পৃথিবীতে নতুন জীবন আনার কারণকে দায়ী করা আমার পক্ষে সহজ ছিল। তাই আমি অস্বাভাবিক কিছুর গভীরে গিয়ে দেখা ইচ্ছাকে সচেতনভাবে দমন করে রেখেছিলাম।

আমরা যখন খুশি থাকি, সময় খুব তাড়াতাড়ি কেটে যায় এবং খুব তাড়াতাড়ি আমার ৩য় ট্রাইমেস্টার চলে আসে। যাকে বলে গর্ভাবস্থার নবম মাস। আমাকে যখন ওরা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল আমার তখন মনে হচ্ছিল আমি চাঁদের উপর রয়েছি এবং ২০১৬ সালের জুন মাসে মোটামুটি একটা তারিখ দেওয়া হয়। একজন নার্স বলেছিলেন আমার সন্তানের জন্মদিন সম্ভবত ২৫ জুন হবে। আমি তখন আমার খুশি ধরে রাখতে পারছিলাম না। তখন আমি আমার পেটে ব্যথা অনুভব করি।

ভয়ঙ্কর সেই রাত

আমার মনে আছে ডাক্তার এবং নার্সরা প্রথম সত্যিই আতঙ্কিত হয়েছিলেন যখন তারা আমাকে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট করতে, ধড়ফড় করতে এবং বিছানায় বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখেছিলেন। গর্ভবতী মায়েদের এই ধরনের উপসর্গ দেখা স্বাভাবিক ছিল না এবং আমার প্রাথমিক স্ক্যানে তখনও পর্যন্ত গুরুতর কিছু সামনে আসেনি।

এক রাতে (এটা সম্পূর্ণরূপে নার্সরা আমাকে পরে যা বলেছিল তার উপর ভিত্তি করে, কারণ এর বেশিরভাগ সময় আমি অজ্ঞান ছিলাম) আমার রক্তচাপ প্রচুর বেড়ে গিয়েছিল, ২২০ থেকে ২৫০ এর মধ্যে। পরের মিনিটে আবার ৬০ থেকে ৭০, চিকিৎসার মান অনুযায়ী শুধুমাত্র জীবিত বলা হয়। আমি কেবল কল্পনা করতে পারি যে সেই সময় আমার পরিবারের কী অবস্থা হয়েছিল। ভাভেশ আমার এবং সন্তানের জন্য চিন্তা করে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং আমি যখন অজ্ঞান ছিলাম তখন তারা এমআরআই এবং একটি আলট্রাসোনোগ্রাফি সহ কিছু অতিরিক্ত পরীক্ষা করে এই সমস্যার কারণ জানার জন্য। যদিও আমার প্রসবের দিন প্রায় এগিয়ে এসেছিল।

হাসপাতালের এক চিকিৎসক তাদের জানান, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, মূত্রাশয়ে কিছু অস্বাভাবিক ভর রয়েছে। তখন তারা ক্যান্সার সন্দেহ করেছিল, কিন্তু সেইসময়ে আমাকে একটি অনকোলজিক্যাল চিকিৎসা ব্যবস্থায় নিয়ে যাওয়া খুব ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, কারণ আমি আমার গর্ভাবস্থার একটি জটিল পর্যায়ে ছিলাম।   

অন্ধকার এবং আলো

আমার চারদিকে তখন শুধুই অন্ধকার। ভাভেশ পরে আমাকে জানায় যে, ডাক্তাররা আমার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য জরুরী সিজারিয়ান পদ্ধতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেইমতো ২০১৬ সালের ১৪ই জুন পিহু এই পৃথিবীতে আসে।

এবং আমি মারা যায়। ওয়েল, মেডিক্যালি। প্রসবের সময় আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং আমাকে লাইফ সাপোর্টে রাখতে হয়েছিল। আমার পরিবার পিহুর জন্মের খুশি উদযাপন করতে পারেনি, সেই রাতে যখন আমি জ্ঞান ফিরে পায়, তখনই মনে হল প্রাণ ফিরে পেলাম। এবং যখন আমি আমার মেয়েকে দেখেছি, আশপাশের সবাই কে কী বলছে কিছু শুনতে পায়নি। অন্ধকার কেটে এক নতুন আলোর সূচনা হয় এখান থেকে।

একটি যুদ্ধ শেষ হয়, আরেকটি শুরু হয়

আমার ভালো মুহূর্ত ভেঙে গেল যখন ডাক্তার জানালো যে আমার মূত্রাশয়ে টিউমার হয়েছে। সেই সময় তারা ক্যান্সারে আক্রান্ত কিনা তা আমাদের বলতে পারেননি। তারা আমাদের রাজকোট থেকে কয়েক ঘণ্টা দূরে আহমেদাবাদের একটি জনপ্রিয় হাসপাতালে যেতে বলেন। সাধারণত আমি ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ পেলে লাফিয়ে উঠতাম কিন্তু এখন বিষয়টা ছিল আমার জীবনের, আমার মেয়েকে দেখাশোনা করার।

ইতিমধ্যেই তখন আমার মনে খারাপ চিন্তাভাবনা আসতে শুরু করে – আমি যখন জন্ম দিয়েছিলাম তখন আমার ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল! যদি আমি অজান্তেই এই নিষ্পাপ শিশুর শরীর রোগটি ছড়িয়ে দিতাম? আমি আর ভাবতে পারছিলাম না, যে কোনও মা এটা কল্পনা করতে পারেন, আমার সমস্ত উদ্বেগ তখন আমার সদ্যজাত সন্তানকে ঘিরে ছিল। ভাভেশ সেই সময় খুব শক্তিশালী ছিলেন এবং আমি যাতে সঠিক চিকিৎসা পায় সেদিকে জোর দিয়েছিলেন এবং আমাদের মেয়ের শুধু এখনই নয় সারাজীবনের জন্য মায়ের প্রয়োজন। তার হাঁটা দেখার জন্য, তাকে স্কুলে যেতে দেখতে, তার চোঁটের উপর ওষুধ লাগাতে, তার সমস্যাগুলি শুনতে, তার সাথে খেলার জন্য আমাকে সেখানে থাকতেই হত। আমার বেঁচে থাকার দরকার ছিল। তাই তিন মাস পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কান্নাকাটির পর অবশেষে পিহুকে পরিবারের কাছে রেখে আহমেদাবাদে যাওয়ার জন্য ভাভেশের অনুরোধ মেনে নিলাম। এভাবে আমার ক্যান্সারের যাত্রা শুরু হয়।

অপারেশন হবে কি না?

আমার মনে হয় না যে আমিই একমাত্র যে অস্ত্রোপচারকে ভয় পায়। এটি একটি সাধারণ দ্বিধা, এবং সাধারণত যখন ডাক্তার আপনাকে বলে যে তারা অপারেশন করবে না, আপনি খুশি হন। আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি।

আহমেদাবাদের ডাক্তাররা একটি DOTA স্ক্যান (এক ধরনের কার্যকরী সিটি স্ক্যান) করেছিলেন যে আমার সত্যি ক্যান্সারের টিউমার ছিল কিনা জানতে। এবং প্রায় সব টিউমারের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা প্রয়োজন। আমার ক্ষেত্রে অবশ্য আলাদা, ডাক্তাররা বলেছে তারা চাইলেও অপারেশন করতে পারে না। টিউমারগুলি আমার মূত্রাশয়ে ছিল এবং এক মিলিয়নের মধ্যে যা একটি ক্যান্সার। এর কার্যকরী চিকিৎসা করতে তাদের আমার মূত্রাশন অপসারণ করতে হবে।

হাসপাতাল পরিষেবা চালিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু ওরা আমাদের অন্য কোথাও সাহায্যের জন্য যাওয়ার পরামর্শ দেয়। এই সময় আমার একটাই চিন্তা ছিল- আমার সন্তান ঘরে কী করছে। আমার সোনাকে ছাড়া বেঁচে থাকা তখন কঠিন ছিল!

যেহেতু আমরা একটি অন্য হাসপাতাল খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলাম, আমার স্বামী দ্বিতীয় মতামতের জন্য একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডাক্তারকে আমার রিপোর্ট দেখানোর জন্য নিজের পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তারাও একই কথা বলেছিল- আমার ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।

আমার এই জার্নিতে ওতপ্রতোভাবে জড়িত

আহমেদাবাদে একটি হাসপাতাল আছে যা এখন চিরকালের জন্য আমার সমস্ত স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত। তারা ভারতের ক্যান্সার হাসপাতালের একটি সুপরিচিত চেইন, এবং একজন ডাক্তার আমাকে বলেছিলেন যে তারা এটা একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। একজন অনুশীলনকারী ইউরোনোকেলজিস্ট এমন একটি পদ্ধতি বর্ণনা করেছিলেন যেখানে তারা আমার মূত্রাশয় (এবং আমার জরায়ু, ক্যান্সার মেটাস্টেসাইজিং বা পুনরাবৃত্তি হওয়ার ঝুঁকি কমাতে) অপসারণ করবে এবং যদিও জরায়ু প্রতিস্থাপন করা যায় না, তবে তারা আমার মূত্রাশয় সম্পর্কে কিছু করতে পারে।

তারা প্রস্তাব করেছিলেন যে তারা আমার অন্ত্রের লুপগুলো ব্যবহার করে একটি কৃত্রিম মূত্রাশয় “পুনঃগঠন” করবে। কল্পনা করার মতো সুন্দর দৃশ্য নয়! কিন্তু জীবিত থাকা এবং একজন মা হিসেবে এটাই আমার কাছে একমাত্র আশা ছিল। এর মানে হল যে আমি আর কখনও মা হতে পারব না, তবে এই সিদ্ধান্তগুলি খুব সহজ হয়ে যায় যখন আপনার জীবনের ঝুঁকি থাকে।

আমি বললাম হ্যাঁ। কিছুক্ষণ আগেই আার সব অন্ধকার হয়ে গেল। যখন তারা আমাকে সাধারণ অ্যানেস্থেসিয়ায় রাখে, তখন আমি শুধু দুটি জিনিস জানতাম – এই পদ্ধতি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, যার অর্থ আমি তাদের পরীক্ষা অধীনে ছিলাম।

এবং দ্বিতীয় – আমি হয় বেঁচে ফিরবো এবং ভালোভাবে এর থেকে বেরিয়ে আসবো, আমার মেয়ের সঙ্গে খেলতে অথবা আমার মেয়ে মা ছাড়াই বড় হবে। 

জেগে উঠলাম

ওই যে কথায় আছে না, সবুরে মেওয়া ফলে! সেরে উঠতে আমার আরও তিন থেকে চার মাস সময় লেগেছে, এবং আমার মেয়েকে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল, যে খুব তাড়াতাড়ি বড় হচ্ছে। আমার চিকিৎসা আমাকে সময়ের হিসেব রাখতে ভুলিয়ে দিয়েছিল, এবং আমি এই বাচ্চাটিকে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম, যে এখন কথা বলতে, হাঁটতে পারে, এবং আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল!

আমরা রাজকোট পৌঁছানোর পরপরই আমার পরিবার বহু প্রতীক্ষিত মা ও মেয়ের পুনর্মিলনে মেতে উঠেছিল। আমার মনে যে সবার সঙ্গে প্রথম ছবি ক্লিক করার পর আমি কতটা খুশি হয়েছিলাম!

যদিও আমার থেকে আমার মেয়ের ক্যান্সার হতে পারে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। যা নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। সৌভাগ্যবশত, ভাভেশ বিশ্বাসযোগ্য ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন – যাদের মধ্যে অনেকেই একই কথা বলেন : এটি একটি অলৌকিক ঘটনার থেকে কম নয় যে আমি জীবিত এবং পিহুর ক্যান্সারের ঝুঁকি ছিল না।

পিহুর ক্যান্সারের ঝুঁকি ছিল না।

পিহুর জন্য পরীক্ষার সুপারিশ করা হয়েছে: শূন্য।

এই আবিষ্কারের সময় থেকে আমি ক্যান্সার উত্তরাধিকার বিষয়ের উপর অনেক নিবন্ধ পড়াশুনো করেছি। কিন্তু যতই মাস কেটে গেল এবং আমি আমার মেয়েকে আর পাঁচটা বাচ্চার মতো বড় হতে দেখেছি, আমার সন্দেহ দূর হয়ে গেছে।

পিহু এখন বড় হয়েছে। আর সে ক্যান্সার মুক্ত! আমি অবশ্যই সমস্ত চিকিৎসা পেশাজীবী, হাসপাতাল এবং অসাধারণ ব্যক্তিদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানাবো যারা আমার বেঁচে থাকা সফল করেছেন এবং এতো কিছু দিয়েছেন।

ধন্যবাদ।

এটি সত্যিকারের একটি মায়ের গল্প, Onco.com এর টিমের সঙ্গে টেলিফোনিক সাক্ষাৎকারে বর্ণিত। নিবন্ধে প্রকাশিত মতামতগুলি একটি সংস্থা হিসেবে Onco.com এর মতামতকে প্রতিফলিত বা প্রতিনিধিত্ব করে না। আপনি যদি রোগীর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে চান, তাহলে আপনি community@onco.com এ আমাদের লিখে পাঠাতে পারেন।

নোট: আপনি যদি আপনার ক্যান্সার নির্ণয়ের বিষয়ে আমাদের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে চান, অথবা আপনার বর্তমান চিকিৎসার বিষয়ে দ্বিতীয় মতামতের জন্য আজই Onco.com এ কনসালটেশন শুরু করতে পারেন। 

 

Related Posts

Leave a Comment